সাফের শিরোপা জিতে বাংলাদেশের ইতিহাস

স্পোর্টস ডেস্ক: সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নেপালকে ৩—১ ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতল বাংলাদেশ। ইতিহাস রচনা করলেন কৃষ্ণা রাণী—শামসুন্নাহার—সাবিনারা। এ জয় দেশবাসীর, এ জয় যেন শত বাধা পেরিয়ে নারীদের উঠে দাঁড়ানো গল্পের।
কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে আজ স্বাগতিক নেপালের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। সে ম্যাচে প্রথমার্ধেই ২—০ গোলে যাওয়া, দ্বিতীয়ার্ধে নেপালের গোল শোধ। পরে কৃষ্ণার আরেক গোলে ম্যাচে ফেরা। সব মিলিয়ে জমজমাট ফাইনালে শেষ হাসি হাসল বাংলাদেশ।
দ্বিতীয়বারের মতো সাফের ফাইনালে উঠেই বাজিমাত করল লাল—সবুজের দল। ২০১০ সাল থেকে কোচ হিসেবে থাকা ছোটনও পেলেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। জোড়া গোল করে ম্যাচের হিরো হলেন কৃষ্ণা। স্বব্ধ করলেন খেলা দেখতে আসা নেপালের হাজারো দর্শকদের।
আজকের ম্যাচ দেখলে মনেই হবে না যে এটি কোনো ফাইনাল চলছে। কারণ মাঠে কোনো দর্শকদের উত্তেজনা নেই। সব আলো কেড়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। তাই মাঠের গ্যালারিতে ছিল পিনপতন নীরবতা। খেলা যে নেপালের মাঠে। আর তাদের হারিয়েই কিনা ইতিহাসে নাম লেখালো বাঘিনীরা।
প্রথমার্ধে তুলনামূলক দাপুটে ফুটবল খেলা বাংলাদেশ বিরতির পর পরিকল্পনা পাল্টে খানিকটা রক্ষণাত্মকভাবে খেলে। তাতে গোল খাওয়ার পর আবারও শাণায় আক্রমণ। আসে সাফল্য। মাঠে সাবিনার নেতৃত্বে সবসময় সরব ছিলেন কৃষ্ণা, বদলি নামা শামসুন্নাহার জুনিয়ররা। যখনই আক্রমণে গেছে নেপাল, তখনই দলগতভাবে সেটা সামলে নিয়ে আবারও নিজেরা সাজিয়েছেন পাল্টা আক্রমণ। সব মিলিয়ে টুর্নামেন্টে যোগ্য দল হিসেবে ট্রফি জিতে নিলো ছোটনের দল।
বৃষ্টির কারণে মাঠ ভারী থাকায় গোছানো ফুটবল খেলতে সমস্যা হচ্ছিল দুই দলেরই। তবে শুরুতে ছন্নছাড়া ফুটবলের প্রদর্শনী হলেও ধীরে ধীরে বল নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেন বাংলাদেশ—নেপালের মেয়েরা। জমে উঠে দুই দলের ফাইনাল।
গ্যালারিতে স্বাগতিকদের পক্ষে আছে হাজারো দর্শক। কিন্তু সে চাপকে যেন আজ শক্তিতে পরিণত করে লাল জার্সীধারীরা। গোটা টুর্নামেন্টে দারুণ ফুটবল খেলা বাংলাদেশ আজও শুরুতেই পায় সাফল্য। ম্যাচের ১০ মিনিটে স্বপ্নাকে উঠিয়ে শামসুন্নাহার জুনিয়রকে বদলি নামান কোচ ছোটন। চার মিনিট পরে মনিকা চাকমার ডান প্রান্ত থেকে করা ক্রস বক্সের মধ্যে দারুণভাবে কোনাকুনি প্লেসিংয়ে বল জালে জড়ান শামসুন্নাহার। ১—০ গোলে এগিয়ে যায় দল।
গোল হজমের পর নিজেদের শক্তি দেখাতে শুরু করে নেপাল। তারা যে ভারতের মতো দলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে, সেটার প্রমাণ পাওয়া যাওয়া একের পর এক আক্রমণে। কিন্তু বাংলাদেশও থেমে থাকেনি। নেপালের আক্রমণ সামলে কাউন্টার অ্যাটাকে গেছে কয়েকবার। যদিও শুরু থেকেই দাপুটে ফুটবল খেলে বাংলাদেশই।
ম্যাচের ৩৬ মিনিটে গোল শোধ করার দারুণ সুযোগ পেয়েছিল স্বাগতিকেরা। কিন্তু প্রতিপক্ষের ফ্রি—কিক দারুণভাবে ঠেকিয়ে দেন বাংলাদেশ গোলরক্ষক রুপ্না চাকমা। সেখান থেকে পাওয়া কর্নারেও প্রায় গোল পেয়ে গিয়েছিল নেপাল। কিন্তু গোলের লাইন থেকে সেটা ক্লিয়ার করে দেন বাংলাদেশ দলের ডিফেন্ডার।
৬ মিনিট পরে আবারও ম্যাচে এগিয়ে যায় বাংলাদেশই। হতাশ করে দেয় নেপালের গ্যালারি—ভর্তি দর্শকদের। মিডফিল্ডের খানিকটা সামনে থেকে এক থ্রুতে বল পান কৃষ্ণা রাণী। কিন্তু সেখানে তাকে মার্কড করার কেউই ছিল না। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ঠান্ডা মাথায় বাকি কাজটা সারেন। ২—০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় বাংলাদেশ।
দ্বিতীয়ার্ধে যেন নেপালকে খানিকটা আক্রমণের সুযোগ করে দিয়ে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলান ছোটন। তাতে প্রতিপক্ষের আক্রমণে কয়েকবার দলের রক্ষণাভাগে কাঁপন ধরে। মাঝে একবার বেঁচেও যায় বাংলাদেশ।
ম্যাচের ৫২ মিনিটে ডি—বক্সের মধ্য থেকে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা নেপাল ফুটবলার রাশমি কুমারীর হেড চলে যায় বারের পাশ দিয়ে। নিশ্চিত গোল হজম করা থেকে বেঁচে যায় বাংলাদেশ।
তবে ৭০ মিনিটে গোল করে ম্যাচে ফেরে স্বাগতিকেরা। নেপালের হয়ে জালের দেখা পান বেসন্ত। বাম পাশ থেকে আক্রমণ শানায় নেপাল। বক্সের মধ্যে বল পেয়ে কোনাকুনি শটে গোল আদায় করে নেন বেসন্ত। চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ।
কিন্তু গোল হজমের ৭ মিনিট পরেই বাংলাদেশের জয় অনেকটা নিশ্চিত করেন ফরোয়ার্ড কৃষ্ণা রাণী। মাঝমাঠ থেকে পাওয়া বলে শেষ পেরেকটি ঢুকান তিনি। দেখা পান জোড়া গোলের। বাংলাদেশও ইতিহাস গড়ে ৩—১ গোলের জয়ে। বাকি সময়টা কয়েকবার আক্রমণে গেলেও আর গোলের দেখা পায়নি কোনো দল।
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে আজ দারুণ ছিলেন দলের গোলরক্ষক রুপা চাকমা। নেপালের কয়েকটি নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে দেন তিনি। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে ব্যথা পাওয়ার পরও যেভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে গোলবার সামলেছেন সেটা ছিল দেখার মতো।
উল্লেখ্য, খেলাটি একদিকে স্বাগতিকদের মাঠে আর এর আগে সাফে তিন বারের দেখায় নেপালের বিপক্ষে কোনো জয়ের রেকর্ড ছিল না বাংলাদেশের মেয়েদের। তাই ট্রফি জিততে সানজিদাদের কঠিন পরীক্ষা দিতে হতো। সেই হিমালয় সমান বাধা টপকেই জিতলেন শিরোপা।