আন্তর্জাতিক: বাংলাদেশি কহিনুর আক্তার বাফেলোর একটি বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় থাকেন তিন সন্তান নিয়ে। দুই বছর আগে ছেলে-মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্যই তার বাফেলো যাওয়া।
মাসে এক হাজার ডলারের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। বাফেলো যাওয়ার আগে তিনি থাকতেন নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউ এলাকায়। তখন তাকে বাসা ভাড়া দিতে হতো মাসে প্রায় ২ হাজার ডলার।কহিনুরের স্বামী বাংলাদেশে থাকেন, পেশায় ঠিকাদার। দেশ থেকে এনেই সন্তানদের পেছনে ব্যয় করছেন তারা। তাই একটু সাশ্রয়ের আশায় কহিনুর গিয়েছিলেন বাফেলোতে।
বাফেলো যাওয়ার পর তার কঠিন অভিজ্ঞতা হয়েছে। চুরির ভয়ে বহু রাত নির্ঘুম থাকতে হয়েছে। এছাড়া যাতায়তসহ রয়েছে নানা ঝামেলা। মাঝে একটু ভালো এলাকায় বাড়ির কেনার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কহিনুর আক্তার বলেন, মাটি কামড়ে থাকতে চেয়েছিলাম সন্তানদের ভবিষ্যতের দিকে থাকিয়ে। কিন্তু আর হবে না।
সদ্য তুষার ঝড়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো না। চার দিন, চার রাত ছিলাম বিদ্যুতবিহীন। ঠান্ডার মধ্যে কাটাতে হয়েছে এ রাত-দিনগুলো। গ্যাসের চুলা জালিয়ে রান্না ঘরে কাঁথা কম্বল মুড়িয়ে কাটাতে হয়েছে রাতের পর রাত। অন্ধকারে মনে হয়েছে ‘একেকটি রাত যেন কেয়ামতের রাত’।
কহিনুর আক্তার বলেন, আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা ভাষায় বলে বুঝানো যাবে না। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেছি বরফের স্তুপের মধ্যে লাশ পড়ে রয়েছে দিনের পর দিন। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর বাফেলো থাকবো না, পরিস্থিতি ভালো হলেই ফিরে যাবো নিউইয়র্ক সিটিতে। জ্যাকাসন হাইটসের ৩৭ এভিনিউর একটি পরিচিত বিল্ডিংয়ে থাকতেন বাংলাদেশি আনিসুর রহমান। তিনি এক বছর আগে নিজের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে তিন সন্তান নিয়ে বাফেলোতে নগদ অর্থ দিয়ে বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এক দালালের প্ররোচনায় ১৫ বছরের নিউইয়র্ক সিটি ছেড়ে বাফেলো গিয়েছিলেন আনিসুর রহমান। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুযোর্গের পর তিনি প্রকাশ্যে কাঁদছেন। সিটির বন্ধু-বান্ধব এবং স্বজনরা খবর নিতে গেলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন আনিসুর রহমান।
তিনি বলেন, যে রাতে তুষার শুরু হয় তার একটু আগেই আমি গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরি। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি রাখার কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় তুষার ঝড়। সকালে দেখি সবশেষে, বাড়ির দরজা বন্ধ, ঘরের কার্নিস পর্যন্ত স্নো। কোনোভাবেই দরজা খুলতে পারছি না। অবস্থা দেখে সন্তানরা কাঁদতে শুরু করে। ঘরের হিট বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই। জানালা দিয়ে বাইরের তাকানোরও সুযোগ পাচ্ছি না। প্রতিবেশি পরিচিত কয়েকজনকে ফোন করেও কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই করতে করতে দুপুরের পর মোবাইলের চার্জও শেষ হয়ে যায়। অসংখ্যবার ৯১১ কল করেছি কেউ রিসিভ করে নাই। এভাবে দুই দিন দরজা বন্ধ অবস্থায় বাড়িতে আটকে ছিলাম। ওই সময় মনে হয়েছে বন্দিদশা থেকে আর মুক্তি মিলবে না। মিলিয়ন ডলার দিলেও আর বাফেলোতে থাকবো না। যেভাবে হোক ফিরে যাবে নিউইয়র্ক সিটিতে।
চিত্রাওয়াগার বাংলাদেশি হুমায়ুন আহমেদ চোখে মুখে এক ধরনের আতংক নিয়ে জানান, আমরা বাফেলোবাসি ‘কেয়ামত’ দেখেছি। এতোদিন সন্ত্রাস, চুরি, ডাকাতির ভয় দেখে দেখে সময় কাটালেও এবার যা দেখেছি তা অবর্ণনীয়। ভুতুড়ে বাফেলো, প্রশাসনহীন বাফেলো, কেউ কারো সাহার্য্যে এগিয়ে না আসা বাফেলো দেখেছি, এ এক কঠিন অভিজ্ঞতা। যা নিজ চোখে না দেখলে বা কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, গত সামারেই আমরা মুভ করেছি।
আসলেই বন্ধু-বান্ধবদের পাল্লায় পড়ে বাফেলো বসবাস শুরু করি। আমাদের বুঝা উচিৎ ছিল কেন বাফেলোতে বাড়ি ঘরের দাম কম, কেন বাফেলোর মানুষগুলো এসব বাড়ি ফেলে রেখে পালিয়েছিলো। তুষার ঝড়ের পর বাফেলোর বাংলাদেশিরা কাঁদছে। অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ তুষার ঝড়ে বাফেলোতো মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩০ এ উন্নীত হয়েছে।
বাফেলোতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। নিউইয়র্কের পশ্চিমাঞ্চলীয় ২ লাখ ৭০ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই সিটিতে গত সোমবার প্রচন্ড ঝড়ের পাশাপাশি তুষারপাতের মাত্রাও ছিল অত্যধিক এবং কোনো কোনো স্থানে ৪৯ ইঞ্চি তুষারপাত হয়েছে বলে আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে। ঝড়ের পর ৫ দিন কেটে গেলেও পুরো বাফেলো এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। বুধবার রাত পর্যন্ত ১৫ হাজার পরিবার বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিল। লোকজন বাড়ি থেকে বের হয়ে কেনাকাটা শুরু করলেও খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। জরুরী কাজে ব্যবহৃত যানবাহন ছাড়া সাধারণ যানবাহন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ বহাল রয়েছে।
সিটি মেয়র বলেছেন যে সিটির সকল রাস্তা থেকে এখনো তুষার অপসারণের কাজ শেষ হয়নি। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া লোকজনকে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্টেট গভর্নর ক্যাথি হকুল বলেছেন যে ঝড়ের তা-বে বহু গাড়ি ছিটকে খানাখন্দকে পড়েছে, যা উদ্ধার করতে বহু সময় লেগে যাবে।
অনেক উদ্ধারকারী যানবাহনও তুষারেরর স্তুপে আটকা পড়েছে বলে তিনি জানান। সোমবার রাতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিউইয়র্ক স্টেটের ইমার্জেন্সি ডিজাস্টার ডিক্লারেশন অনুমোদন করেছেন।
এরি কাউন্টির নির্বাহী মার্ক সি পলোন কার্জ বলেছেন যে বাফেলোতে যে ২৮ জন মারা গেছে এর মধ্যে ২৭ জনই তার কাউন্টির। ১৪ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে বাড়ির বাইরে এবং তিনটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে একটি গাড়িতে। ৪ জন মারা গেছে বাড়িতে হিটিং সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়ায় এবং তিনজন মারা গেছে বাড়ির বাইরে তুষার অপসারণ করতে গিয়ে হৃদরোগজনিত কারণে।